ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

পণ্য কিনে ঠকেছেন? জেনে নিন প্রতিকার

চট্টগ্রামের একটি মোবাইল এক্সারসাইজ দোকান থেকে একটি মোবাইল স্ক্রিন কিনেছিলেন কক্সবাজার সিটি কলেজের প্রভাষক ইকবাল হোসাইন। তবে স্ক্রিনটি মোবাইলের সাইজ থেকে একটু বড় ছিলো। কিন্তু দোকানী বলেছিল তাতে কোনো সমস্যা হবে না। পাশের পরিচিত একটি মেকানিকও দেখিয়ে দিয়েছিলেন ওই দোকানী। স্ক্রিনটি বড় হওয়ায় তা লাগাতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেন মেকানিক। মেকানিক জানান- আকারে বড় হওয়ায় তা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আগে তা না বলে বলেছিল পরে। এই জন্য ইকবাল হোসাইন মেকানিক ও দোকানীকে দায়ী করেন। তাদের কাছে অভিযোগ করলে উল্টো ক্ষেপে যায় তারা। কিন্তু ভোক্তা অধিকার বিষয়ে সচেতন ছিলেন ইকবাল হোসাইন। তিনি বেশি বাড়াবাড়ি না করে সোজা অভিযোগ করেন ভোক্তা অধিকার কার্যালয়ে। তিন দিনের মাথায় অভিযুক্তদের নোটিশ ইস্যু করেন ভোক্তা অধিকার কার্যালয় থেকে। ১৫দিন পর তাদের ডাকাহয়। দু’পক্ষকে নিয়ে শুনানী শেষে দোকানী ও মেকানিককে পাঁচহাজার টাকা করে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সেখান থেকে নিয়ম মতে ২৫% পায় ইকবাল হোসেন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র মতে, পণ্যের গায়ে ধার্য করা মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া অপরাধ এবং একধরনের প্রতারণা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৪০ নম্বর ধারা অনুযায়ী এটি শাস্তিযোগ্য।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ প্রতিরোধে ২০০৯ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল বাজার তদারকির মাধ্যমে এই আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়। এই আইনের ৩৭ থেকে ৪০ নম্বর ধারাগুলোয় বলা হয়েছে, মোড়কের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের খুচরা বিক্রয়মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখা না থাকা, পণ্য ও সেবার মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করা এবং নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্য দাবি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব অপরাধে অনূর্ধ্ব এক বছরের কারাদ- বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান আছে। এসব ধারায় (৩৭ থেকে ৪০) ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত ১১ হাজার ৯৩৮টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ১৪ লাখ ৪৭ হাজার ৯৫০ টাকা জরিমানা করেছে অধিদপ্তর।

প্রথম দিকে জনবল কম থাকায় এবং জনগণ এই আইন সম্পর্কে সচেতন না থাকায় অভিযোগের সংখ্যা কম ছিল। ভোক্তা অধিকার নিয়ে গণশুনানি ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির পর অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে। গত বছর ৩১৯টি গণশুনানি ও ১ হাজার ২০০ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে যেখানে অভিযোগ জমা পড়েছিল ১ হাজার ৬২২টি, সেখানে চলতি বছরের শুধু জুলাই মাসে ১ হাজার ৬৪টি অভিযোগ জমা পড়ে। এই আইন আরও কার্যকর করতে জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে।

অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে অভিযোগের সংখ্যা ছিল ৭৩টি, ২০১১ সালে ৫টি, ২০১২ সালে ৬৯টি, ২০১৩ সালে ৩২টি, ২০১৪ সালে ৫৩৭টি, ২০১৫ সালে ২২৫টি, ২০১৬ সালে ১ হাজার ৬২২টি এবং এ বছরের প্রথম সাত মাসে অভিযোগ পড়েছে ৬ হাজার ৬০টি।

অধিদপ্তরের জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক মো. মাসুম আরেফিন বলেন, সরাসরি অভিযোগ করার পাশাপাশি ই-মেইলে অভিযোগ করার সুযোগ থাকায় সারা দেশ থেকেই এখানে অভিযোগ আসছে। তবে অধিকাংশ অভিযোগই রাজধানীবাসীর করা এবং এই ভোক্তারা বয়সে তরুণ। তিনি বলেন, ভোক্তারা যেসব অভিযোগ করেন, তার প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্যের মূল্য বেশি নেওয়া সংক্রান্ত। আবার এই অভিযোগগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশই রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার ও সহজে প্রমাণ করার সুযোগ থাকায় এ ধরনের অভিযোগ বেশি হচ্ছে। শুধু রেস্তোরাঁ নয় অন্যান্য পণ্য ক্রয় করতে গিয়েও মানুষ ঠকে। তবে সেসব ক্ষেত্রে অভিযোগ কম আসে।

যেভাবে অভিযোগ করবেন:www.dncrp.gov.bd এই ওয়েবসাইট থেকে ‘অভিযোগ ফরম’ নামাতে হবে। ফরম হাতে লিখে পূরণ করতে হবে। স্ক্যান করে বা ক্যামেরায় ছবি তুলে তা [email protected] এই ঠিকানায় ই-মেইল করতে হবে। সঙ্গে বিল বা ভাউচার যুক্ত করতে হবে। অভিযোগপত্রটি ০২৮১৮৯৪২৫ এই নম্বরে ফ্যাক্সও করা যাবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ১, কারওয়ান বাজারে (টিসিবি ভবন, ৮ম তলা) এসেও সরাসরি অভিযোগ করা যাবে। অবশ্যই ঘটনা ঘটার এক মাসের মধ্যে অভিযোগ করতে হবে।

পণ্যের গায়ের মূল্যের চেয়ে বেশি দাম নিলে এবং রেস্তোরাঁয় খাবারের ঝোলানো মূল্যতালিকার চেয়ে বেশি টাকা নিলে ভোক্তা অভিযোগ করতে পারবেন। অভিযোগ প্রাপ্তির ১০/১২ দিনের মধ্যে অধিদপ্তর থেকে ফোনে বা ই-মেইলে অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তকে শুনানির জন্য ডাকা হবে। উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে অধিদপ্তরে শুনানি হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয় দ- করা যাবে। অর্থদ- দিলে পরিশোধের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হবে। বেঁধে দেওয়া সময়ে ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অর্থ পরিশোধ করা হলে আবার অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযোগকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগকারী এসে অধিদপ্তরের আদায় করা অর্থ দ-ের ২৫ শতাংশ নিয়ে যাবেন।

অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি: ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ধারা ৭৬ (১) অনুযায়ী, “যে কোন ব্যক্তি, যিনি, সাধারণভাবে একজন ভোক্তা বা ভোক্তা হইতে পারেন, এই অধ্যাদেশের অধীন ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য সম্পর্কে মহাপরিচালক বা এতদুদ্দেশ্যে মহাপরিচালকের নিকট ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অবহিত করিয়া লিখিত অভিযোগ দায়ের করিতে পারিবেন।”

যেখানে অভিযোগ দায়ের করা যাবে: মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ১ কারওয়ান বাজার (টিসিবি ভবন-৮ম তলা), ঢাকা, ফোন: +৮৮০২ ৮১৮৯৪২৫। জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্র, টিসিবি ভবন- ৯ম তলা, ১ কারওয়ান বাজার ঢাকা, ফোন: ০১৭৭৭ ৭৫৩৬৬৮, ই-মেইল: [email protected] , উপ পরিচালক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি ভবন, বন্দরটিলা, চট্টগ্রাম, ফোন: ০৩১-৭৪১২১২। উপ পরিচালক, রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, শ্রীরামপুর, রাজশাহী, ফোন: +৮৮০৭ ২১৭৭২৭৭৪। উপ পরিচালক, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি ভবন, শিববাড়ী মোড়, খুলনা, ফোন: ০৪১-৭২২৩১১। উপ পরিচালক, বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, মহিলা ক্লাব ভবন, বরিশাল, ফোন: +৮৮০৪ ৩১৬২০৪২। উপ পরিচালক, সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, সিলেট ফোন: ০৮২১-৮৪০৮৮৪। উপ পরিচালক, রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, রংপুর, ফোন: ০৫২১-৫৫৬৯১। এছাড়াও প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করা যাবে।

যেভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হবে: দায়েরকৃত অভিযোগ অবশ্যই লিখিত হতে হবে। ফ্যাক্স, ই-মেইল, ওয়েব সাইট, ইত্যাদি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে; বা অন্য কোন উপায়ে; অভিযোগের সাথে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের রশিদ সংযুক্ত করতে হবে। অভিযোগকারী তাঁর পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা ও মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল নম্বর (যদি থাকে) এবং পেশা উল্লেখ করবেন।

পাঠকের মতামত: